১
১৩২৫ সালে সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলক শাহ দিল্লীতে বন্দি গৌড়ের বলবানী সুলতান বাহাদুর শাহ কে মুক্তি দেন এবং তাঁকে শর্তসাপেক্ষে বঙ্গ (পূর্ব বাংলা) শাসনের অনুমতি প্রদান করেন। শর্ত ছিলো এই যে, খুতবায় তাঁর নামের পাশাপাশি অধিরাজ হিসেবে দিল্লীর সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলকের নামও উচ্চারণ করতে হবে। সেই সাথে মুদ্রায় নিজের নামের সাথে দিল্লীর সুলতানের নামও খোদাই করতে হবে। অর্থাৎ বাহাদুর শাহ স্বাধীন থাকবেন ঠিকই কিন্তু ‘সার্বভৌমত্ব’ হারাবেন!
যিনি গৌড়ের বিখ্যাত সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের পুত্র, যিনি ছিলেন হিন্দুস্তানের বিখ্যাত সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের বংশধর, তাঁর জন্য তুঘলকদের বশ্যতা স্বীকার করা ছিলো অত্যন্ত অপমানের! তথাপি বাহাদুর শাহ্ তাঁর প্রস্তাবে রাজি হন এবং চলে আসেন বঙ্গের প্রাণকেন্দ্র সোনারগাঁও-এ।
৩ বছর পর ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে স্বাধীনচেতা সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পরাক্রমশালী দিল্লী সালতানাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মতো শক্তি-সামর্থ্য কোনোটাই সেইসময় ছিলো না বাহাদুর শাহর! এরপরেও বলবানী বংশধর বাহাদুর শাহ্ বিদ্রোহের ঘোষণা করেন।
হিন্দুস্তানের সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলক শাহ এই বিদ্রোহ দমনের জন্য প্রেরণ করেন বিশাল বাহিনী। তুঘলক বাহিনী এবং বাহাদুর শাহর বাহিনী মুখোমুখি হয় বর্তমান বাংলাদেশের গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে।
এই যুদ্ধে সুলতান বাহাদুর শাহ পরাজিত ও বন্দি হন এবং তাঁকে শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বাহাদুর শাহর চামড়া ছাড়িয়ে সেই চামড়া ও কর্তিত মস্তক পাঠানো হয় দিল্লীর শাহী দরবারে! বাহাদুর শাহর চামড়া দিল্লীর বিজয় গম্বুজে টানাবার নির্দেশ দেন সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলক শাহ।
২
বাহাদুর শাহের বিদ্রোহ দমনের পর বাংলা কে বিদ্রোহমুক্ত রাখতে সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলক বাংলাকে তিন প্রদেশে বিভক্ত করে তিনজন গভর্নর নিযুক্ত করেন।
এই তিন প্রদেশ হলো— ১. গৌড় ২. বঙ্গ ও ৩. রাঢ়
গৌড়ের প্রাদেশিক রাজধানী ছিলো লখনৌতি, বঙ্গের রাজধানী সোনারগাঁও ও রাঢ়ের রাজধানী সাতগাঁও
গৌড়ের শাসনকর্তা হিসেবে মালিক কদর খান কে নিযুক্ত করা হয়। বঙ্গের গভর্নর নিযুক্ত করা হয় সুলতানের পালক ভাই বাহরাম খান কে এবং রাঢ়ের গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয় আজম-উল-মুলক ইজাজউদ্দিন ইয়াহিয়া কে।
১৩৩৮ সালে বঙ্গের গভর্নর মালিক বাহরাম খান মৃত্যুবরণ করলে তাঁর সিলাহদার ফখরা সোনারগাঁও-এর ক্ষমতা দখল করেন এবং ‘ফখর-উদ্ব-দ্বীন মুবারক শাহ’ নাম ধারণ করে নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করেন।
বাহাদুর শাহর বিদ্রোহ দমনের ১০ বছর পর বাংলার সোনারগাঁও-এ জ্বলে উঠলো আরেকটি বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ!
সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহর বিদ্রোহের খবর পেয়ে গৌড় ও রাঢ়ের গভর্নরদের কে নির্দেশ দেওয়া হলো বিদ্রোহ দমনের জন্য। মালিক কদর খান ও আজম-উল-মুলক ইয়াহিয়া স্ব-স্ব সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাত্রা করলেন সোনারগাঁও অভিমুখে। দুই পক্ষের সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণে সুলতান মুবারক শাহ পরাজিত হয়ে পিছু হটলেন ও দক্ষিণে নোয়াখালী-ফেনী অঞ্চলে আশ্রয় নিলেন।
সোনারগাঁও থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে ইয়াহিয়া সাতগাঁও ফিরে গেলেও কদর খান থেকে গেলেন সোনারগাঁও-এই।
কদর খান একটি নিন্দনীয় কাজ করেছিলেন। তা হলো– সোনারগাঁও থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ সব নিজের কাছেই জমা করে রেখেছিলেন। সৈন্যদের তাদের প্রাপ্য ভাগ প্রদান করেন নি। ফলে সৈনিকরা ক্ষুব্ধ ছিলো ও ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফুঁসে উঠছিলো।
বর্ষা মৌসুমে নদীবহুল পূর্ব-বাংলার নদ-নদীসমূহ দানবে রূপান্তরিত হয় এবং খালগুলোও যেন পরিণত হয় নদীতে। এই সময় অশ্বারোহী বাহিনী অচল হয়ে পড়ে কেননা কর্দমাক্ত মাটি ঘোড়ার চলাচলের অনুপযুক্ত। ঠিক একই ঘটনা ঘটলো কদর খানের সাথে। বর্ষা আসতেই তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী অচল হয়ে পড়লো। এই সময় সুলতান মুবারক শাহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে শক্তিশালী নৌবাহিনী নিয়ে সোনারগাঁও আক্রমণ করলেন।
এইসময় সম্পদের ভাগ না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ সৈন্যরা বিদ্রোহের ডাক দিয়ে মুবারক শাহর সাথে যোগ দেন এবং তারাই কদর খান কে হত্যা করেন। ফলে সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ্ সোনারগাঁও পুনর্দখল করতে সক্ষম হন।
লেখক: রাজিত তাহমীদ জিত
তথ্যসূত্র: ১. বাংলার প্রাথমিক যুগের স্বাধীন সুলতানদের মুদ্রা ও কালক্রম — নলিনীকান্ত ভট্টশালী
২. বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর : স্বাধীন সুলতানদের আমল — অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়
[ নিচের মানচিত্রে সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলক বাংলাকে যে তিন খণ্ডে বিভক্ত করেছিলেন সেই তিনটি প্রদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে। সেই সাথে, বর্তমানের বিহার রাজ্যের সাথে মধ্যযুগে বিহার রাজ্যের যে বিস্তর তফাৎ ছিলো তাও এই মানচিত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ]
বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ( পর্ব ২)
১
সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ্ মালিক কদর খান কে পরাজিত ও নিহত করে পুনরায় সোনারগাঁও-এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর গৌড় প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার জন্য তাঁর অধীনস্থ সেনাপতি মালিক মুখলিস খান কে গৌড় প্রদেশের রাজধানী লখনৌতিতে প্রেরণ করেন।
বাংলার ঐতিহ্যবাহী রাজধানী গৌড়ের অবস্থান ছিলো অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায়। বর্তমানে গৌড় মালদহ জেলার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরী ; যা এখন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেন বংশীয় রাজা লক্ষণ সেন গৌড় নগরীর সংস্কারের মাধ্যমে একে নতুন জীবনদান করেছিলেন এবং নিজের নামে শহরটির নামকরণ করেছিলেন ‘লক্ষ্মণাবতী’। মুসলিম বিজয়ের পর মুসলিম শাসকদের ফার্সি-প্রভাবিত উচ্চারণে ‘লক্ষ্মণাবতী’ পরিণত হয় ‘লখনৌতি’তে।
মুবারক শাহর আদেশ মালিক মুখলিস সসৈন্যে লখনৌতি দখলের জন্য অগ্রসর হন। কিন্তু, গৌড় প্রদেশের সেনাধ্যক্ষ আলী মুবারক যুদ্ধের মাধ্যমে মালিক মুখলিস কে পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। আলী মুবারক হিন্দুস্তানের সুলতানের প্রতি প্রথমদিকে অনুগত থাকলেও কিছুকাল পর নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করে খুতবা পাঠ ও মুদ্রা প্রবর্তন করেন।
তিনি আলাউদ্দিন আলী শাহ উপাধি ধারণ করেছিলেন।
এভাবে বঙ্গ ও গৌড় — হিন্দুস্তানের দুইটি প্রদেশ স্বাধীন হয়ে গেলো।
সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ পূর্বদিকে তাঁর রাজ্যসীমা বিস্তার করেন। তিনি ত্রিপুরার রাজাকে পরাজিত করে কুমিল্লা অঞ্চল এবং ১৩৪০ সালে চট্টগ্রাম জয় করেন। এই অঞ্চলের স্থানীয় ছোট ছোট হিন্দু রাজাদের বশ্যতা স্বীকার করান তিনি।
ইবনে বতুতা মুবারক শাহর রাজত্বকালেই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বঙ্গে এসেছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম কে উল্লেখ করেছেন “সাদকাওন” হিসেবে।
২
বঙ্গের শেষ বলবানী সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহর এক বিশ্বস্ত সেনাধ্যক্ষ ছিলেন হাজী মুহম্মদ ইলিয়াস।
তিনি তদানীন্তন ইলখানাত ভুক্ত পারস্যের ‘সিজিস্তান’ বা ‘সিস্তান’ প্রদেশ থেকে এসেছিলেন বিধায় তাঁর পুরো নাম ছিলো হাজী মুহম্মদ ইলিয়াস আস-সিস্তানী।
দুই শত্রুভাবাপন্ন সাম্রাজ্য মামলুক সালতানাত এবং ইলখানাত পাশাপাশি অবস্থিত হওয়ায় সেই যুগে মামলুক সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত মক্কা-মদিনায় গিয়ে হজ পালন করা ছিলো অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। খুব কম মানুষই হজ পালন করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারতেন।
মুহম্মদ ইলিয়াস তরুণ বয়সেই এই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন বিধায় তাঁর নামের পূর্বে ‘হাজী’ শব্দটি যুক্ত হয়ে গিয়েছিলো।
তিনি পিতার মৃত্যুর পর ভাগ্যের সন্ধানে হিন্দুস্তানের রাজধানী দিল্লীতে (তুঘলকাবাদ) আসেন এবং সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলক শাহর চাচাতো ভাই ও সচিব মালিক ফিরুজ বিন রজবের প্রহরী হিসেবে যোগ দেন। হাজী ইলিয়াসের দুধ ভাই আলী মুবারক পূর্ব থেকেই মালিক ফিরুজের অধীনে চাকরি করতেন।
সিস্তানী পারসিক পুরুষরা অত্যন্ত সুঠামদেহী ও বলশালী হওয়ায় তাদেরকে ডাকা হতো ‘পালোয়ান’ বা ‘পাহলেওয়ান’ বলে। সুঠামদেহী, দীর্ঘকায় ও কর্মঠ হওয়ায় সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সময় থেকেই দিল্লী সালতানাতের রাজদরবারে সিস্তানী পালোয়ানদের ছিলো বিশেষ কদর। সিস্তানী পালোয়ানদের পাহারায় দিল্লী সালতানাতের দরবার অনুষ্ঠিত হলে মনে হতো যেন দৈত্যদের প্রহরায় দরবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটি দিল্লীর শাহী দরবারের জৌলুস বৃদ্ধি করতো।
কোনো এক অজানা অপরাধে হাজী ইলিয়াস মালিক ফিরুজ কর্তৃক পদচ্যুত ও বিতাড়িত হয়েছিলেন। সমসাময়িক ইতিহাস গ্রন্থে কারণটি সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। মালিক ফিরুজ কর্তৃক পদচ্যুত হওয়ার পর হাজী ইলিয়াস বঙ্গের রাজধানী সোনারগাঁও আসেন
এবং সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহর বাহিনীতে যোগ দেন। নিজ গুণে তিনি অল্পকাল পরেই কায়েদ পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তায় উন্নীত হন। ‘কায়েদ’ বলতে সেই সময় ১০০০ সৈন্যের অধিনায়ক বোঝাতো।
১৩২৮ সালে যুদ্ধের সময় ইলিয়াস বাহাদুর শাহর সাথেই ছিলেন। সুলতান বাহাদুর শাহ তুঘলক বাহিনীর হাতে ধৃত ও অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হওয়ার সময় কিছুই করার ছিলো না বিশ্বস্ত হাজী ইলিয়াসের! তিনি রণাঙ্গন ত্যাগ করে নিজ জীবন রক্ষা করেন এবং সোনারগাঁও থেকে চলে আসলেন বিহারে।
দিল্লী থেকে বিতাড়িত এই ইলিয়াসই প্রায় এক দশক মনিবের সাথে তুঘলক বাহিনীর নির্মমতার উপযুক্ত প্রতিশোধ নিয়েছিলেন তুঘলকদের থেকে ; এই ইলিয়াসই পালটে দিয়েছিলেন বাংলার পুরো ইতিহাস।
লেখক: রাজিত তাহমীদ জিত
বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ( পর্ব ২)
১
সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ্ মালিক কদর খান কে পরাজিত ও নিহত করে পুনরায় সোনারগাঁও-এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর গৌড় প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার জন্য তাঁর অধীনস্থ সেনাপতি মালিক মুখলিস খান কে গৌড় প্রদেশের রাজধানী লখনৌতিতে প্রেরণ করেন।
বাংলার ঐতিহ্যবাহী রাজধানী গৌড়ের অবস্থান ছিলো অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায়। বর্তমানে গৌড় মালদহ জেলার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরী ; যা এখন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেন বংশীয় রাজা লক্ষণ সেন গৌড় নগরীর সংস্কারের মাধ্যমে একে নতুন জীবনদান করেছিলেন এবং নিজের নামে শহরটির নামকরণ করেছিলেন ‘লক্ষ্মণাবতী’। মুসলিম বিজয়ের পর মুসলিম শাসকদের ফার্সি-প্রভাবিত উচ্চারণে ‘লক্ষ্মণাবতী’ পরিণত হয় ‘লখনৌতি’তে।
মুবারক শাহর আদেশ মালিক মুখলিস সসৈন্যে লখনৌতি দখলের জন্য অগ্রসর হন। কিন্তু, গৌড় প্রদেশের সেনাধ্যক্ষ আলী মুবারক যুদ্ধের মাধ্যমে মালিক মুখলিস কে পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। আলী মুবারক হিন্দুস্তানের সুলতানের প্রতি প্রথমদিকে অনুগত থাকলেও কিছুকাল পর নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করে খুতবা পাঠ ও মুদ্রা প্রবর্তন করেন।
তিনি আলাউদ্দিন আলী শাহ উপাধি ধারণ করেছিলেন।
এভাবে বঙ্গ ও গৌড় — হিন্দুস্তানের দুইটি প্রদেশ স্বাধীন হয়ে গেলো।
সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ পূর্বদিকে তাঁর রাজ্যসীমা বিস্তার করেন। তিনি ত্রিপুরার রাজাকে পরাজিত করে কুমিল্লা অঞ্চল এবং ১৩৪০ সালে চট্টগ্রাম জয় করেন। এই অঞ্চলের স্থানীয় ছোট ছোট হিন্দু রাজাদের বশ্যতা স্বীকার করান তিনি।
ইবনে বতুতা মুবারক শাহর রাজত্বকালেই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বঙ্গে এসেছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম কে উল্লেখ করেছেন “সাদকাওন” হিসেবে।
২
বঙ্গের শেষ বলবানী সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহর এক বিশ্বস্ত সেনাধ্যক্ষ ছিলেন হাজী মুহম্মদ ইলিয়াস।
তিনি তদানীন্তন ইলখানাত ভুক্ত পারস্যের ‘সিজিস্তান’ বা ‘সিস্তান’ প্রদেশ থেকে এসেছিলেন বিধায় তাঁর পুরো নাম ছিলো হাজী মুহম্মদ ইলিয়াস আস-সিস্তানী।
দুই শত্রুভাবাপন্ন সাম্রাজ্য মামলুক সালতানাত এবং ইলখানাত পাশাপাশি অবস্থিত হওয়ায় সেই যুগে মামলুক সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত মক্কা-মদিনায় গিয়ে হজ পালন করা ছিলো অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। খুব কম মানুষই হজ পালন করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারতেন।
মুহম্মদ ইলিয়াস তরুণ বয়সেই এই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন বিধায় তাঁর নামের পূর্বে ‘হাজী’ শব্দটি যুক্ত হয়ে গিয়েছিলো।
তিনি পিতার মৃত্যুর পর ভাগ্যের সন্ধানে হিন্দুস্তানের রাজধানী দিল্লীতে (তুঘলকাবাদ) আসেন এবং সুলতান মুহাম্মাদ ইবনে তুঘলক শাহর চাচাতো ভাই ও সচিব মালিক ফিরুজ বিন রজবের প্রহরী হিসেবে যোগ দেন। হাজী ইলিয়াসের দুধ ভাই আলী মুবারক পূর্ব থেকেই মালিক ফিরুজের অধীনে চাকরি করতেন।
সিস্তানী পারসিক পুরুষরা অত্যন্ত সুঠামদেহী ও বলশালী হওয়ায় তাদেরকে ডাকা হতো ‘পালোয়ান’ বা ‘পাহলেওয়ান’ বলে। সুঠামদেহী, দীর্ঘকায় ও কর্মঠ হওয়ায় সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সময় থেকেই দিল্লী সালতানাতের রাজদরবারে সিস্তানী পালোয়ানদের ছিলো বিশেষ কদর। সিস্তানী পালোয়ানদের পাহারায় দিল্লী সালতানাতের দরবার অনুষ্ঠিত হলে মনে হতো যেন দৈত্যদের প্রহরায় দরবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটি দিল্লীর শাহী দরবারের জৌলুস বৃদ্ধি করতো।
কোনো এক অজানা অপরাধে হাজী ইলিয়াস মালিক ফিরুজ কর্তৃক পদচ্যুত ও বিতাড়িত হয়েছিলেন। সমসাময়িক ইতিহাস গ্রন্থে কারণটি সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। মালিক ফিরুজ কর্তৃক পদচ্যুত হওয়ার পর হাজী ইলিয়াস বঙ্গের রাজধানী সোনারগাঁও আসেন
এবং সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহর বাহিনীতে যোগ দেন। নিজ গুণে তিনি অল্পকাল পরেই কায়েদ পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তায় উন্নীত হন। ‘কায়েদ’ বলতে সেই সময় ১০০০ সৈন্যের অধিনায়ক বোঝাতো।
১৩২৮ সালে যুদ্ধের সময় ইলিয়াস বাহাদুর শাহর সাথেই ছিলেন। সুলতান বাহাদুর শাহ তুঘলক বাহিনীর হাতে ধৃত ও অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হওয়ার সময় কিছুই করার ছিলো না বিশ্বস্ত হাজী ইলিয়াসের! তিনি রণাঙ্গন ত্যাগ করে নিজ জীবন রক্ষা করেন এবং সোনারগাঁও থেকে চলে আসলেন বিহারে।
দিল্লী থেকে বিতাড়িত এই ইলিয়াসই প্রায় এক দশক মনিবের সাথে তুঘলক বাহিনীর নির্মমতার উপযুক্ত প্রতিশোধ নিয়েছিলেন তুঘলকদের থেকে ; এই ইলিয়াসই পালটে দিয়েছিলেন বাংলার পুরো ইতিহাস।
লেখক: রাজিত তাহমীদ জিত